মানুষের কথা ভালো ও মন্দ পরিণতি নিয়ে তার কাছেই ফিরে আসে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপর প্রহরী তার কাছেই আছে।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ১৮)
তাই মুমিন তার বাক্য ব্যয়ে সংযত হয়ে থাকে। সে মন চাইলে কোনো কথা বলে না।
কথায় সংযত হওয়া আবশ্যক কেন
যেসব কারণে ইসলাম কথায় সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, তা হলো-
১. জিহ্বা সংযতকারীর জন্য জান্নাত : যারা নিজের জবান সংযত করতে পারবে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহ্বা) এবং দুই রানের মধ্যবর্তী অঙ্গের (লজ্জাস্থান) সংযত রাখার নিশ্চয়তা আমাকে দেবে, আমি তাঁর জান্নাতের জিম্মাদার। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৪)
২. কল্যাণকর কথা মুমিনের বৈশিষ্ট্য : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন কল্যাণকর কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩৬)
৩. বেশি কথায় বেশি ভুল : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে তার ভুল বেড়ে যায়।
যার ভুল বেড়ে যায় তার পাপ বেড়ে যায়। আর যে বেশি পাপ করে সে জাহান্নামের পথে বেশি এগিয়ে যায়। (ফয়জুল কাদির, হাদিস : ৮৯৯০)
যেসব কথা পরিহারযোগ্য
মুমিন দৈনন্দিন জীবনে সব মন্দ ও অসার কথা পরিহার করবে। নিম্নে এমন কিছু পরিহারযোগ্য কথার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।
যেমন :
১. গাইরুল্লাহর নামে শপথ করা : আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি কাফেলার সঙ্গে ওমর (রা.)-কে এরূপ অবস্থায় পেলেন যে সে সময় তিনি তাঁর বাবার নামে শপথ করছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাবার নামে শপথ করতে নিষেধ করছেন। হয় শপথকারী আল্লাহ তাআলার নামে শপথ করবে, না হয় নীরব থাকবে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৫৩৪)
২. দ্বিধা রেখে কল্যাণ চাওয়া : মহান আল্লাহর কাছে সুনিশ্চিত কল্যাণ চাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা রাখা আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণের নামান্তর।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ এভাবে দোয়া কোরো না, হে আল্লাহ! তুমি চাইলে আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি চাইলে আমার প্রতি রহম করো। তুমি চাইলে আমাকে রিজিক দাও, বরং দোয়াপ্রার্থী খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে দোয়া করবে। কেননা তিনি যা চান তাই করেন। তাঁকে বাধ্য করার কেউ নেই। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৭৭)
৩. মুখমণ্ডল বিকৃতির দোয়া করা : কারো মুখমণ্ডল বিকৃতির দোয়া করা নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ বলেন, তোমরা বোলো না, আল্লাহ তার মুখমণ্ডল বিকৃত করুন। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১৭১)
৪. অপরাধ ঢাকতে আল্লাহর নাম : অনেকে কোনো কিছু না করেও বলে, আল্লাহ জানেন আমি এটা করেছি। মূলত নিজের অপরাধ ঢাকতেই মানুষ এমনটি করে। এটা নিষিদ্ধ। কেননা এই ব্যক্তি হয়তো আল্লাহকে অজ্ঞ মনে করে অথবা তার ভেতর আল্লাহর ভয় নেই।
৫. কারো অবয়বের নিন্দা করা : চেহারা ও অবয়ব আল্লাহর দান। আল্লাহর সৃষ্টি প্রতিটি মানুষই সুন্দর। তাই কারো চেহারা বা অবয়বের নিন্দা করা অনুচিত। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা : ত্বিন, আয়াত : ৪)
৬. মানুষকে বরকতের উৎস বলা : বরকতের মালিক কেবল আল্লাহ। তাই কোনো মানুষকে বরকতের উৎস বলা নিষিদ্ধ। যেমন তিনি আমাদের বরকতময় করেছেন বলা। ইরশাদ হয়েছে, ‘বরকতময় তিনি, সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১)
৭. আল্লাহও জুলুম করুক বলা : কারো জুলুম ও অবিচারের শিকার হয়ে এমন বলা নিষেধ যে ‘তুমি যেমন আমার প্রতি জুলুম করেছ, আল্লাহও তোমার প্রতি জুলুম করুক।’ কেননা আল্লাহ ইনসাফ করেন, কারো প্রতি জুলুম করেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪০)
৮. এমন হওয়া উচিত হয়নি বলা : কেউ কোনো বিপদে পড়লে অনেকে বলে, আল্লাহ এমন কেন করলেন? তার ক্ষেত্রে এমন হওয়া উচিত হয়নি। এভাবে বলা নিষিদ্ধ। কেননা এতে তাকদির তথা আল্লাহর নির্ধারণের ব্যাপারে আপত্তি করা হয়। আর আল্লাহ বলেন, ‘তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২৩)
৯. সময়কে দোষারোপ করা : সময় বা যুগকে গালি দেওয়া বা দোষারোপ করা নিষিদ্ধ। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, মানুষ কালকে গালি দেয়, অথচ আমিই কাল (এর নিয়ন্ত্রক)। একমাত্র আমারই হাতে রাত ও দিনের পরিবর্তন ঘটে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৮১)
১০. শিল্পকর্মকে সৃষ্টিকর্ম বলা : শিল্পীর শিল্পকে সৃষ্টিকর্ম এবং তাঁর প্রতিভাকে সৃজনশীলতা বলার সাধারণ প্রবণতা রয়েছে। তবে মুমিনের উচিত তা পরিহার করা। কেননা মহাজগতে একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো, আল্লাহ সব বস্তুর স্রষ্টা। তিনি এক ও পরাক্রমশালী।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১২)
১১. দ্বিনি প্রতীকের নাম বিকৃত করা : দ্বিন ও শরিয়তের প্রতীকগুলোর নাম বিকৃত করা নিষিদ্ধ। কেননা তা ইসলামের প্রতীকের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। আর আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘এটাই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করলে তা তো তার হৃদয়ের তাকওয়া সঞ্জাত।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩২)
১২. আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না বলা : জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহর শপথ! আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে মাফ করবেন না। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, সে ব্যক্তি কে? যে শপথ খেয়ে বলে যে আমি অমুককে মাফ করব না? আমি তাকে মাফ করে দিলাম এবং তোমার আমল (শপথ)-কে নষ্ট করে দিলাম।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৫৭৫)
আল্লাহ সবাইকে মন্দ কথা পরিহারের তাওফিক দিন। আমিন।